নিলামে উঠছে এমারেল্ড অয়েল, কোন পথে যাবে বিনিয়োগকারীরা!
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলের সম্পত্তি নিলামে তুলছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। ঋণ পরিশোধ ব্যর্থ হওয়ায় ‘অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩’এর ধারা ৩৩/১ মতে কোম্পানিটির বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলামে তুলছে ব্যাংকটি।
বেসিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১১ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত আরোপিত ও অনারোপিত সুদসহ এমারেল্ড অয়েলের কাছে ক্যাশ ক্রেডিট এবং টার্ম লোন হিসেবে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা মোট ১৪০ কোটি টাকা পাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি বেসিক ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করছে না। ঋণ আদায়ে ব্যাংকটি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করেছে। আদালতের রায় অনুযায়ী ঋণের টাকা উদ্ধারের জন্য কোম্পানিটির বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি।
কোম্পানিটির সম্পদ নিলামে তোলার আগে শেরপুরের আদালত বেসিক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে ঢোল বাজিয়ে নিলামের বিষয়টি জানানোর জন্য। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বেসিক ব্যাংক ঢোল বাজিয়ে কোম্পানিটির নিলামের কথা জানান দিয়েছে এমারেন্ড ওয়েল কর্তৃপক্ষকে। আদালতের নিয়ম অনুযায়ী ঢোল বাজিয়ে জানানোর ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিলামের তারিখ নির্ধারণ করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিবে বেসিক ব্যাংক। সে হিসেবে আগামী সপ্তাহে অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষে নিলামের তারিখ নির্ধারণ হবে বলে আজ (বুধবার) শেয়ারনিউজকে নিশ্চিত করেছেন বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ারনিউজকে বলেন, নিলামের বিষয়ে আমরা কোনো নোটিশ পাইনি। তবে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে ঢোল বাজিয়ে নিলামে তোলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু শেরপুরে অবস্থিত কোম্পানিটির পরিদর্শনে গেলে শেয়ারনিউজকে বিষয়টি কোম্পানিটির শ্রমিক ও এলাকাবাসী ঢোল বাজানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই শেয়ারনিউজের প্রতিনিধি এমারেন্ড ওয়েলের কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।
বেসিক ব্যাংকের এমডি আনিসুর রহমান শেয়ারনিউজকে জানান, ঢোল বাজিয়ে নিলামের ঘোষণা দেওয়ার জন্য শেরপুরের আদালত ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে। আমরা সেটা সম্পন্ন করেছি। নিয়ম অনুযায়ী ঢোল বাজানোর পর অর্থাৎ আদালতের নির্দেশে অনুযায়ি আগামী সপ্তাহে নিলামের তারিখ ঠিক করা হবে।
ব্যাংকের ঋণ
বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় ঋণের গ্যারান্টার এবং বন্ধক দাতাগণ ছিলেন কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি গালিব, চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, পরিচালক সজন কুমার বসাক এবং অমিতাভ ভৌমিক। কোম্পানিটি ঋণ খেলাপি হওয়ার পর বেসিক ব্যাংক অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে এই চার ব্যক্তিকে বিবাদি করে। যা তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়েছে। এই মামলা এখনও দুদকে চলমান।
কিন্তু মাঝে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ২০২১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. শফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় কোম্পানিটিতে। বাকি চার পরিচালকের মধ্যে রয়েছেন বিআইবিএমের ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার ও সজীব হোসেন এবং ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব। কিন্তু এই পর্ষদও কোম্পানিটির এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এগোতে পারলেন না।
সে সময়ে বিএসইসি থেকে বেসিক ব্যাংকে বলা হয়েছে এমারেল্ড অয়েলের ঋণের সুদ মওকুফ করে ঋণ রিসিডিউল করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা করতে হলে বেসিক ব্যাংকের ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইন অমান্য করতে হয়। ব্যাংকের আইন অনুযায়ী কোন ঋণের সুদ মওকুফ করতে হলে ঋণ গ্রহিতাকে উপস্থি হয়ে ব্যাংক বরাবর আবেদন করতে হয়। সেই আবেদনের আলোকে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহিতা যেহেতু ঋণ খেলাফী হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন, তাই সুদ মওকুফ করার কোন সুযোগ নেই বলছে ব্যাংকের এমডি আনিসুর রহমান।
অপরদিকে, ঋণ রিসিডিউল করার ক্ষেত্রে ব্যাংককে আগে পূর্বের মামলা তুলে নিতে হবে। তারপর ঋণ রিসিডিউল করতে হবে। বেসিক ব্যাংকের এমডি বলেন, আগের বোর্ড বেসিক ব্যাংকের কাছে সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছে। সেই সম্পত্তি নিলামে উঠানোর উদ্দেশ্যেই আমরা মামলা করেছি। কিন্তু নতুন করে ঋণ রিসিডিউল করতে হলে আগে মামলা তুলে নিতে হবে। কিন্তু নতুন পর্ষদতো আমাদের কাছে নতুন করে কোনো সম্পদ বন্ধক বা জামানত রাখবে না। কারণ এমারেল্ড অয়েলের যে সম্পদ রয়েছে তা আগের পর্ষদের নামে। তাহলে নতুন পর্ষদকে আমরা কিভাবে ঋণ রিসিডিউল করে দেব।
এরপর শফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে নতুন পর্ষদ গঠিত হয়েছে এমারেল্ড অয়েলের। নতুন এই পর্ষদও এখন পযন্ত ঋণ পরিশোধ করার জন্য কোনো প্রকার উদ্বোগ গ্রহণ করেননি বলে ব্যাংকটির এমডি জানান।
বেসিক ব্যাংকের এমডি বলেন, এমারেল্ড অয়েলের নতুন পর্ষদ চাইলে ১৪০ কোটি টাকা এক সাথে পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু ঋণ রিসিডিউল করতে পারবে না।
এছাড়াও, কোম্পানিটিকে নতুন করে উৎপাদনে ফিরিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। উৎপাদনে ফেরার এই খবরে কোম্পানিটির শেয়ার ১০ টাকার কমে থাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রথম দফায় ৩২ টাকায়। এরপর আবার মিনোরি বাংলাদেশ নামে একটি কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর জাপানি একাধিক কোম্পানি এমারেল্ড অয়েছের বোর্ডে বসার জন্য শেয়ার কিনেছে বাজার থেকে। এই খবরে ৩০ টাকার শেয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮২ টাকার বেশি। অর্থাৎ মাত্র মাত্র আড়াই মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ১৫২ টাকা ৩০ পয়সা বা ৫০৪ শতাংশ। সর্বশেষ কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৫৬ টাকা ২০ পয়সায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়ত উল ইসলাম শেয়ারনিউজকে বলেন, কোম্পানিটি ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেছে। ব্যাংক এশিয়া এবং বেসিক ব্যাংককে ঋণ পরিশোধের জন্য চিঠিও দিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক এশিয়ার ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের সাথে মামলা থাকার কারণে একটু দেরি হচ্ছে। আশা করছি সমাধান হয়ে যাবে।
কোম্পানির উৎপাদন
এমারেন্ড ওয়েলের কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোম্পানিটি বর্তমানে নামে মাত্র উৎপাদনে আছে। কোম্পানিটির বন্ধ হওয়ার আগে যেখানে ৫০০ এর অধিক কর্মচারী ছিল, নতুন করে উৎপাদনে ফেরার পর মাত্র ৭০ জন কর্মচারী দিয়ে উৎপাদন চালু রেখেছে। এই ৭০ জন কর্মচারীও ঠিকভাকে কাজ করতে পারে না। কারণ সপ্তাহে দুই দিন মাত্র কোম্পানিটি উৎপাদন করে থাকে। তাও আবার মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার জন্য উৎপাদন কাজ চলমান থাকে। কোম্পানিটি পরিদর্শনকালে শেয়ারনিউজের কাছে এমন চিত্রই উঠে আসে।
কোম্পানিটির শ্রমিক নুরুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানিটিতে কাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করা তাদের জন্য কঠিন। কারণ এর আগে নির্ধারিত বেতনে মাসিক হিসেবে কাজ করতাম। তখন কাজ হোক বা না হোক কোম্পানিকে শ্রমিকদের মাস শেষে বেতন দিতে হতো। কিন্তু এখন আর কোম্পানিটি মাসিকভাবে শ্রমিক নিয়োগ দেয় না। ঘণ্টা হিসেবে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করায়। যে কয় ঘণ্টা কাজ হয়, সে কয় ঘন্টার বেতন দেওয়া হয়। এতে করে একজন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা আয় করতে পারে।
যার ফলে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করার জন্য এখন আর শ্রমিকরা অপেক্ষা করে না। অন্য কোন কাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে বলে শেয়ারনিউজকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শ্রমিক।
উৎপাদনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ারনিউজকে বলেন, কোম্পানিটি প্রতিদিনই উৎপাদনে রয়েছে।
কিন্তু কোম্পানিটিতে কাজ করা একাধিক শ্রমিক শেয়ারনিউজকে বলেন, সপ্তাহে মাত্র দুই দিন এমারেল্ড অয়েল উৎপাদন করে। তাও আবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
কোম্পানিটিতে কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ধানের কুড়ো। সেই কুড়োও যোগান দেয় গাজীপুরের এক পার্টি। সেই পার্টির গাড়ির ড্রাইবার আশিকুল (ছদ্মনাম) শেয়ারনিউজকে বলেন, আমাদের কুড়োর অনেক টাকা বাকি রয়েছে। কোম্পানিটি টাকা ঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছে না।
আবার কুড়ো থেকে উৎপাদিত স্পন্দন তৈল ভারতের যে পার্টিকে দেওয়া হয়, সেখান থেকেও কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ অগ্রিম টাকা নিয়ে তৈল উৎপাদন করে থাকে। তারপরেও ঠিকভাবে কেন কোম্পানিটি চলছে না। আমাদের মাথায় কাজ করে না। তাহলে এতো টাকা নিয়ে কোম্পানিটি করে কি? এমন কথা বলেন ওই ড্রাইভার।
ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির এমডি পিআরও ডিপার্টম্যান্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি ব্যস্ত আছি।
পরে পিআর ডিপার্টম্যান্টে যোগাযোগ করলে তিনি লিখিত প্রশ্ন চান। লিখিত প্রশ্ন ই-মেইল করলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। পরে কল করলে তিনি কল কেটে দেন।